Monday, April 21, 2025

শেষ ট্রেন (সম্পূর্ণ গল্প)

 

শেষ ট্রেন (সম্পূর্ণ গল্প)

রাত তখন দশটা বাজে। ঢাকার গুলিস্তানের এক কোণে বসে আছে রিয়াজ। তার সামনে এক কাপ ঠাণ্ডা হয়ে যাওয়া চা, আর পকেটে শেষ সম্বল—একটা মোচড় খাওয়া ৫০ টাকার নোট।

https://pawgleamed.com/i1sname7p?key=5083636343b9a544a789f490c4e0291b আজ সকালেই সে এসেছিল নারায়ণগঞ্জ থেকে, একটা ছোট চাকরির ইন্টারভিউ দিতে। কলেজ শেষ করে গত এক বছর ধরে বিভিন্ন চাকরির জন্য চেষ্টা করে যাচ্ছে, কিন্তু প্রতিবারই ব্যর্থতা।
আজকের ইন্টারভিউটাও সেই তালিকায় আরেকটা নাম যোগ করল। “তোমার সিভি ভালো, কিন্তু আমাদের অভিজ্ঞ লোক দরকার”—এই এক কথায় বিদায়।

শহরের কোলাহল কমে এসেছে, দোকানপাট বন্ধ হতে শুরু করেছে। ট্রেন ছাড়া তার ফিরে যাওয়ার উপায় নেই, তাই হেঁটেই রওনা দিল কমলাপুর স্টেশনের দিকে। পথে যেতে যেতে চোখে জল আসে না, কিন্তু ভিতরটা যেন ভার হয়ে আছে।

স্টেশনে পৌঁছতেই দেখে অপেক্ষমাণ যাত্রীরা বসে আছে। দূরে একটা বেঞ্চিতে বসে আছে এক বৃদ্ধ, গায়ে সাদা-ময়লা পাঞ্জাবি, হাতে একটা ছড়ি। মুখে একটা মায়াবী হাসি। রিয়াজ পাশে গিয়ে বসে। বৃদ্ধ নিজেই কথা শুরু করেন:

— "এই সময়ে এখানে বসে আছো, কোথায় যাবে বাবা?"
— "নারায়ণগঞ্জ। ট্রেন ধরতে এসেছি।"
— "মনটা কি খুব খারাপ?"
— "হ্যাঁ, চাকরির ইন্টারভিউ দিতে এসে ব্যর্থ হলাম। এমন মনে হচ্ছে, জীবনটাই ভুল পথে হাঁটছে।"

বৃদ্ধ ধীরে ধীরে মাথা নাড়লেন। তারপর বললেন,

— "জীবনে যত বড় মানুষ দেখেছো, তাদের সবাই একদিন না একদিন এমন রাস্তা দিয়ে হেঁটেছে। আমি এক সময় এই স্টেশনেই বাদাম বিক্রি করতাম। কারো কাছে ভিক্ষাও চেয়েছি।"

রিয়াজ একটু চমকে উঠল, অবিশ্বাসের চোখে বৃদ্ধের দিকে তাকাল।

— "হ্যাঁ বাবা। বাবাকে ছোটবেলায় হারিয়েছি, পড়াশোনা করতে পারিনি। হাতে একটা পুরানো ঠেলা গাড়ি নিয়ে বাদাম বিক্রি করতাম। প্রথম প্রথম দিনে ১০-১৫ টাকাও উঠত না। কিন্তু একদিন এক লোক এসে বলল, 'তুই যদি চেষ্টা করিস, আমি তোকে ৫০০০ টাকা ঋণ দিতে পারি, সুদ ছাড়াই।' আমি রাজি হলাম। ছোট একটা চায়ের দোকান দিলাম। তারপর সেই দোকান বড় হলো। এখন আমার নারায়ণগঞ্জে ফার্নিচারের দোকান আছে, পঁচিশটা ছেলে আমার অধীনে কাজ করে।"

রিয়াজ কিছুক্ষণ চুপ করে থাকল। এরপর বলল,
— "কিন্তু কিভাবে এতটা সাহস পেলেন? আমি তো বারবার হেরে যাচ্ছি।"

বৃদ্ধ তখন একটা কথা বললেন, যেটা রিয়াজের মাথায় গেঁথে গেল:

— "যে মানুষ হারে, সে মানুষ নয়—সে জিততে শেখে। হারা মানে শেষ নয়। অনেক সময় জীবন আমাদের একটু থামিয়ে দেয়, যাতে আমরা দৌড় শুরু করার আগে ঠিক পথে দাঁড়াই।"

ঠিক তখনই ঘোষণা হলো: নারায়ণগঞ্জগামী শেষ ট্রেন আসছে। রিয়াজ উঠে দাঁড়াল। বৃদ্ধ তার দিকে তাকিয়ে বললেন:

— "এই শেষ ট্রেনটা হয়তো তোর জন্য শেষ সুযোগ না—বরং নতুন শুরুর যাত্রা। মনে রাখিস, কিছু মানুষ জীবনে একটাই ট্রেন মিস করে আর ফিরতে পারে না, কিন্তু কিছু মানুষ ঠিক শেষ ট্রেনেই জীবনের সঠিক গন্তব্যে পৌঁছে যায়। তুই কোনটা হতে চাস?"

রিয়াজ চুপচাপ ট্রেনে উঠল। জানালার পাশে বসে বাইরে তাকিয়ে দেখল—বৃদ্ধ হাত নাড়ছেন। তার ঠোঁটে হাসি, চোখে আশীর্বাদ।

রিয়াজ জানত না ভবিষ্যতে কী হবে, কিন্তু একটা ব্যাপার নিশ্চিত—সে হাল ছাড়বে না। আজ থেকে শুরু হবে তার নতুন পথচলা। শেষ ট্রেনটা তার জীবনের শুরুর সিঁড়ি হয়ে উঠবে।


শেষ কথা:

জীবন কখনো কখনো আমাদের ভেঙে দেয়, শুধু এটা দেখার জন্য—আমরা কীভাবে নিজের টুকরোগুলো জোড়া লাগিয়ে আবার দাঁড়াতে পারি। সবশেষ ট্রেন বন্ধ করে না—কখনো কখনো সেটাই খোলে সব নতুন দরজা।

https://pawgleamed.com/i1sname7p?key=5083636343b9a544a789f490c4e0291b

No comments:

Post a Comment

নিজেকে সরিয়ে নেওয়া মানে পরাজয় নয়—এটা এক ধরনের আত্মরক্ষা, আত্মসম্মানের ভাষা

 নিজেকে সরিয়ে নেওয়া মানে পরাজয় নয়—এটা এক ধরনের আত্মরক্ষা, আত্মসম্মানের ভাষা একটা সময় ছিল, যখন মানুষ ধরে রাখার জন্য প্রাণপণে লড়ে গেছি। মনে হত...